রিয়াজ শাওন:
হাজীগঞ্জে অসচ্ছল সংস্কৃতিসেবীদের মাসিক কল্যান ভাতা পাচ্ছে ঠিকাদার, জনপ্রতিনিধি, ব্যবসায়ী, কৃষকসহ সচ্ছল মানুষ। যাদের অনেকেই কোন ধরনের সংস্কৃতির চর্চা কিংবা সাংস্কৃতিক কাজের সাথে জড়িত নয়! এতে মাসিক কল্যাণভাতা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে প্রকৃত অসচ্ছল সংস্কৃতিসেবীরা।
সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রানালয়ের কল্যান অনুদান খাত থেকে অসচ্ছল সংস্কৃতিসেবীদের মাসিক কল্যান ভাতা প্রদান করা হয়। গত ২০২০-২১ অর্থ বছরে চাঁদপুর জেলায় ৫৬ জনকে এ কল্যাণ ভাতা দেওয়া হয়। এর মাঝে হাজীগঞ্জ উপজেলার ৭ জন পান মাসিক এই কল্যাণ ভাতা।
গত ২০২০-২১ অর্থবছরে হাজীগঞ্জ উপজেলার ভাতা প্রাপ্তরা হলেন, উপজেলার ৫নং সদর ইউনিয়নের মাতৈন গ্রামের মৃত সামছুল হকের ছেলে জহিরুল ইসলাম মাসিক ২১০০ টাকা হারে বছরে মোট ২৫ হাজার ২০০ টাকা, তার আপন ভাই আব্দুল হাই মাসিক ১২০০ টাকা করে মোট বছরে ১৪ হাজার ৪ শত টাকা, একই বাড়ির আবদুল মতিনের ছেলে সিদ্দিকুর রহমান মাসিক ১২০০ টাকা হারে বছরে মোট ১৪ হাজার ৪ শত টাকা, একই গ্রামের ফাতেমা আক্তার রিনা মাসিক ১২০০ টাকা করে বছরে ১৪ হাজার ৪০০ টাকা, উপজেলার ৭নং বড়কূল পশ্চিম ইউনিয়নের সমেষপুরে গ্রামের মৃত মো. চাঁন মিয়া বেপারীর ছেলে ইকবাল হোসেন মাসিক ১২০০ টাকা হারে বছরে ১৪ হাজার ৪০০ টাকা, ৮নং হাটিলা পূর্ব ইউনিয়নের গংঙ্গানগর গ্রামের হরিকুমার রায় এর ছেলে প্রানেশ চন্দ্র রায় ১২০০ টাকা হারে বছরে মোট ১৪ হাজার ৪০০ টাকা ও হাজীগঞ্জ পৌরসভার মকিমাবাদ গ্রামের বাসিন্দা নীহার রঞ্জন হালদার মিলন মাসিক ১২০০ টাকা করে বছরে মোট ১৪ হাজার ৪ শত টাকা উত্তোলন করছেন।
এছাড়াও ২০২১-২২ অর্থবছরে ও আগের অর্থবছরে ভাতা প্রাপ্তদেরকেই দেওয়া হয় এই কল্যান ভাতা। তবে এই অর্থবছরে ভাতার পরিমান বেড়েছে ১০০ টাকা করে। ভাতা পেয়েছে জহিরুল ইসলাম মাসিক ২১০০ টাকা করে বছরে ২৫ হাজার ২০০ টাকা, আব্দুল হাই ১৩০০ টাকা করে মোট ১৫ হাজার ৬০০ টাকা , সিদ্দিকুর রহমান ১৩০০ টাক করে মোট ১৫ হাজার ৬০০ টাকা, ফাতেমা আক্তার ১৩০০ টাকা করে মোট ১৫ হাজার ৬০০ টাকা, ইকবাল হোসেন ১৩০০ টাকা করে মোট ১৫৬০০ টাকা , নীহার রঞ্জন হালদার ১৩০০ টাকা করে মোট ১৫৬০০ টাকা, প্রানেশ চন্দ্র রায় ১৩০০ টাকা করে ১৫৬০০ টাকা ভাতা পান।
গত ২০২০-২১ ও ২০২১-২২ অর্থবছরে হাজীগঞ্জ উপজেলার মাসিক কল্যান ভাতা প্রাপ্ত ৭ জন এর মাঝে ৪ জনই হলেন হাজীগঞ্জ উপজেলার ৫ নং সদর ইউনিয়নের মাতৈন গ্রামের বাসিন্দা। এছাড়াও উপজেলার ভাতা প্রাপ্ত একজন করোনাকালীন সময়ে মৃত্যুবরণ করেছেন।
সরজমিন গিয়ে দেখা যায়, ৫ নং সদর ইউনিয়নের মাতৈন গ্রামের অসচ্ছল মাসিক কল্যাণ ভাতা প্রাপ্ত জহিরুল ইসলাম বসবাস করেন দুইতলা বিল্ডিং এ। বিল্ডিংয়ের ভিতর ও বাহিরের দেওয়ালে লাগানো হয়েছে টাইলস। তার পুরান ঢাকার ইসলামপুরে আছে কাপড়ের ব্যবসা। এ ছাড়াও তিনি এলাকায় ঠিকাদারী ব্যবসার সাথে জড়িত রয়েছেন বলে এমন তথ্য তিনি নিজেই নিশ্চিত করেছেন। ভাতা প্রাপ্ত আরেকজন তার আপন ভাই আব্দুল হাই হাজীগঞ্জের বাজারের বকুলতলা রোডে ব্যবসা করেন। সেখানে তার নিজস্ব দোকান আছে। তারও রয়েছে বিল্ডিং বাড়ি। ভাতা প্রাপ্ত আরেকজন একই বাড়ির সিদ্দিকুর রহমান। তিনি মূলত একজন কৃষক। ভাতা প্রাপ্ত আরেক জন একই গ্রামের বাসিন্দা স্থানীয় সংরক্ষিত নারী ইউপি সদস্য ফাতেমা আক্তার রিনা।
স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা যায়, তারা সিদ্দিকুর রহমান, আব্দুল হাই, জহিরুল ইসলাম ও ফাতেমা আক্তারকে কখনোই কোন ধরনের সংস্কৃতির চর্চা কিংবা কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত থাকতে দেখেননি। অথচ তারা পাচ্ছেন অসচ্ছল সংস্কৃতিসেবীর মাসিক ভাতা।
বিভিন্ন সূত্র বলছে, এই ৪ জনের অসচ্ছল সংস্কৃতিসেবীদের মাসিক ভাতা পাওয়ার মূল কারিগর জহিরুল ইসলাম। তিনি তার গ্রামে একটি পাঠাগার পরিচালনা করেন। সেই পাঠাগারকে পূঁজি করে বিভিন্ন সরকারী দপ্তরে আবেদন করে সরকারি অনুদান সংগ্রহ করেন। জহিরুল ইসলামের নেতৃত্বে মাতৈন গ্রামে গড়ে উঠেছে একটি প্রতারক চক্র। যারা বিভিন্ন সরকারি দপ্তর আবেদন করে নামে-বেনামে নানা ধরনের অনুদান কিংবা ভাতা সংগ্রহ করে। তবে তাদের এই প্রতারণার বিষয়টি স্থানীয় সবাই জানে। যদিও প্রভাবশালী জহিরুল ইসলামের বিরুদ্ধে ভয়ে কেউ মুখ খুলতে চাননি।
অসচ্ছল সংস্কৃতিসেবী মাসিক কল্যান ভাতা প্রাপ্ত জহিরুল ইসলাম কোন সাংস্কৃতিক সংগঠনের সাথে জড়িত এমন তথ্য জানতে চাওয়া হলে তিনি জানান, কোন সাংস্কৃতিক সংগঠনের সাথে জড়িত নয়? তিনি জানান, তিনি মরহুম শামসুল হক স্মৃতি পাঠাগার ও সাংস্কৃতিক সংসদের প্রতিষ্ঠাতা। যদিও বাস্তবে শামসুল হক স্মৃতি পাঠাগারের নাম মাত্র অস্তিত্ব থাকলেও সাংস্কৃতিক সংসদের কোন অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। নামসর্বস্ব এই সাংস্কৃতিক সংসদের নাম বিক্রি করে। তিনি তুলে নিচ্ছেন মাসিক কল্যান ভাতা। একই সংগঠনের সংস্কৃতিসেবী হিসেবে আবদুল হাই ও সিদ্দিকুর রহমানও তুলছেন ভাতা।
জহিরুল ইসলামের কাছে আরো জানতে চাওয়া হয় তিনি অসচ্ছল কি না? তিনি জানান, তিনি অসচ্ছল না। তাহলে কেন অসচ্ছল সংস্কৃতিসেবীদের মাসিক কল্যান ভাতা তুলে নিচ্ছেন? তিনি বলেন, আমি আবেদন করছি। সরকার আমাকে দেয় তাই নেই।
মাসিক কল্যাণ ভাতা প্রাপ্ত সিদ্দিকুর রহমানের সাথে কথা বলতে তার বাড়িতে গিয়ে তাকে পাওয়া যায়নি। তিনি মাঠে কৃষি কাজ করতে গিয়েছেন।
অসচ্ছল সংস্কৃতিসেবী মাসিক ভাতা প্রাপ্ত আরেকজন হাজীগঞ্জের ৫নং সদর ইউনিয়নের সংরক্ষিত মহিলা মেম্বার ফাতেমা আক্তার এর কাছে জানতে চাওয়া হয়, তিনি কোন সাংস্কৃতিক সংগঠনের সাথে জড়িত? তিনি বলেন, আমি ১৯৯৩ সালে স্কুলে পড়ার সময় জারি গান করেছি। এছাড়াও আমি বিভিন্ন সাংস্কৃতিক চর্চা করি। তাই আমি এই ভাতা নিচ্ছি।
স্থানীয়দের সূত্রে জানা যায়, জহিরুল ইসলাম, আব্দুল হাই, সিদ্দিকুর রহমান, ফাতেমা আক্তার রিনা। তারা কেউ কখনো কোন ধরনের সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের সাথে জড়িত নয়।
উপজেলার ৭ নং বড়কূল পশ্চিম ইউনিয়নের সমেষপুর গ্রামের মৃত-মো: চাঁন মিয়া বেপারীর ছেলে মো: ইকবাল হোসেন মূলত একজন ফার্নিচার ব্যবসায়ী, উপজেলার অলিপুর বাজারে তার ফার্নিচারের দোকান রয়েছে।
এছাড়াও সমেষপুর মডেল একাডেমি একটি কেজি স্কুলের মালিক তিনি। তার কাছে জানতে চাওয়া হয়, তিনি কোনো ধরনের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত কিনা? তিনি বলেন, তিনি একজন সংস্কৃতিপ্রেমী। তার একটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। তার সেই প্রতিষ্ঠান উপজেলার বিভিন্ন প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ করে। তিনি নিজেকে সংস্কৃতিকর্মী দাবি করেন। সেই হিসেবে তিনি এই অসচ্ছল সংস্কৃতিসেবীর ভাতা তুলে নিচ্ছেন।
প্রকৃত অর্থে হাজীগঞ্জ অসচ্ছল সংস্কৃতিসেবীর মাসিক কল্যাণ ভাতা প্রাপ্ত ৭জনের মাঝে শুধু মাত্র নীহার রঞ্জন হালদার মিলন ও প্রানেশ চন্দ্র রায় প্রকৃত অসচ্ছল সংস্কৃতিসেবী। বাকী ৫ জন কোন ধরনের সংস্কৃতির সাথে জড়িত নয় জানিয়েছে স্থানীয় সংস্কৃতিকর্মীরা।
এই বিষয়ে হাজীগঞ্জ উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা রাশেদুল ইসলাম বলেন, আমি খোঁজ নিচ্ছি, তারা আসলে সংস্কৃতিসেবী কি না।
উল্লেখ্য, সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে অসচ্ছল সংস্কৃতিসেবীদের ভাতা এবং সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানকে অনুদান প্রদানের নিমিত্ত ‘আর্থিকভাবে অসচ্ছল সংস্কৃতিসেবীদের ভাতা মঞ্জুরি নীতিমালা’ ও ‘সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান অনুদান মঞ্জুরি নীতিমালা’ রয়েছে। নীতিমালা মোতাবেক অসচ্ছল সংস্কৃতিসেবী এবং সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে মন্ত্রণালয়ের নির্ধারিত আবেদন ফরমে জেলা প্রশাসক এবং ঢাকা মহানগরের ক্ষেত্রে মহাপরিচালক, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মাধ্যমে আবেদন করার জন্য বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়ে থাকে।
ReplyForward
|