রিয়াজ শাওনঃ
ছোট কিংবা বড় সবার কাছে সমান ভাবে জনপ্রিয় একটি খেলা হলো ক্যারাম। গ্রামে কিংবা শহরের অলি-গলিতে দোকানে হরহামেশাই দেখা মিলে দলবেঁধে ক্যারাম খেলার দৃশ্য। তবে এখন পাড়া মহল্লার দোকানেই শুধু নয়, অনেকেই ক্যারাম বোর্ড কিনে পরিবারের সঙ্গে ঘরেই খেলেন ক্যারাম।
তীক্ষ্ণ বুদ্ধি আর হাতের কারিশমায় খেলা হয় ক্যারাম। যদিও ক্যারাম এক ধরনের টেবিলটপ খেলা। তবে বিলিয়ার্ডস ও টেবিল শাফলবোর্ড খেলার সঙ্গে এই খেলার কৌশলগত সাদৃশ্য লক্ষিত হয় বলে এই খেলার অপর নাম ফিঙ্গার বিলিয়ার্ডস।
জনপ্রিয় এই ক্যারাম খেলার প্রধান উপকরণ ক্যারাম বোর্ড গত ২০ বছর ধরে হাজীগঞ্জ উপজেলার ৬-৭ টি কারাখানায় তৈরি করা হচ্ছে। এখানকার কারখানাগুলোতে তৈরি হওয়া ক্যারাম বোর্ডগুলো চলে যায় দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বিশেষ করে সিলেট, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, ফেনী কুমিল্লাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গা।
এক সময়ে উপজেলার ক্যারাম বোর্ড তৈরির কারখানাগুলো শ্রমিকদের কর্মব্যস্তা থাকতো চোখে পড়ার মত। শ্রমিকদের হাতুড়ি আর মেশিনের শব্দে চারপাশ থাকতো মুখরিত। কারখানার ভিতরে-বাহিরে এমনকি কারখানার সামনে রাস্তাগুলোতেও সারি সারি করে সাজিয়ে রাখতে দেখাতে যেতো কারখানায় তৈরি হওয়া ক্যারাম বোর্ডগুলো।
তবে হঠৎ করে হাজীগঞ্জের ক্যারাম বোর্ডের তৈরি শিল্পের উপর উপর নেমে এসেছে অর্থনীতিক খরা। যার কারনে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে অধিকাংশ কারখানা।
জানান যায়, হাজীগঞ্জের কারখানাগুলোতে গত কয়েক মাস একেবারে কমে গেছে ক্যারাম বোর্ড ক্রয়ের অর্ডার। পর্যাপ্ত অর্ডার না থাকার ফলে কারখানার মালিকরা ঠিক মত কর্মীদের বেতন দিতে না পেরে কর্মী ছাঁটা করে দিয়েছেন।
হাজীগঞ্জের ১নং সদর ইউনিয়নের ১নং ওয়ার্ড কাজিরগাঁওয়ে অবস্থিত ইছরাত খেলা ঘরের কর্নধার কিরণ প্রধানীয়া জানান, তার দোকানের এক সময় ২৮ জন শ্রমিক কাজ করতো। তখন কাজের চাপে ঠিক মত খাবার খেতে পারতেন না। কিন্তু গত কয়েক মাস ক্যারাম বোর্ড বিক্রি একেবারে কমে গেছে। ফলে তিনি তার কারখানা ২৮ জন শ্রমিক থেকে ছাঁটাই করে এখন মাত্র ৪জন শ্রমিক রেখেছেন।
এর কারন হিসেবে তিনি বলেন, দেশের অর্থনীতি তেমন ভালো না। মানুষ এখন আগে পেটের চিন্তা করে। তারপর অন্য কিছু। জিনিস-পত্রের যে দাম মানুষ এখন তার জীবন চলাতেই কষ্ট হয়। যার ফলে এখন মানুষ জীবন নিয়ে ব্যস্ত। তাই মানুষ ক্যরাম বোর্ড কিনে কম। ফলে আমাদের অর্ডারও কম। অর্ডার নাই, বিক্রি নাই। তাই কারখানাও চালাইতে পারি না।
হাজীগঞ্জ পৌরসভার স্টেশন রোড বটতলায় অবস্থিত ফারজানা স্টোরের কারখানার ভিতর-বাহির আশেপাশে এক সময় দেখা যেতো ক্যারাম বোর্ড তৈরির বিশাল কর্মযগৎ। কারখানার বাহিরে কিংবা রাস্তার পাশে সারি সারি করে ক্যারাম বোর্ড সাজিয়ে রাখতে দেখা যেতে৷ কিন্তু এখন তার কারখানায় দুই একটির বেশি ক্যারাম বোর্ডের দেখা যায় না।
এই বিষয়ে কারখানার মালিক বোরহান শেখ বলেন, আমার দোকানে আগে কর্মী ছিলো ১২-১৩ জন। আর এখন আমি একাই কাজ করি। কাজ একেবারে নাই। কারখানা বন্ধ করে দিয়েছি। মানুষ এখন ক্যারাম বোর্ড কিনে না।
হঠাৎ ক্যারাম বোর্ড বিক্রি কমে যাওয়ার কারন হিসেবে তিনি মনে করেন, মানুষের হাতে টাকা নাই, মানুষ এখন পেট চালাইতে কষ্ট হয়। ফলে এখন মানুষ খেলাধুলার জিনিসপত্র কিনে টাকা নষ্ট করতে চায় না। তাছাড়া মানুষ এখন ইন্টারনেটে সময় নষ্ট করে। খেলাধুলায় সময় কম দেয়। এছাড়াও মোবাইলে ক্যরাম খেলা যায়৷ সব মিলে আমাদের একেবারে খারাপ অবস্থা যাচ্ছে।
হাজীগঞ্জ সরকারি মডেল কলেজ রোর্ডে অবস্থিত খোকন ক্যারাম হাউজের মালিক খোকন বলেন, আগে এত কাজ থাকতো যে ঠিক মত খাবার খাওয়া সময় পাইতাম না। দোকানে ১৪-১৫ জন লোক কাজ করতো প্রতিদিন। এখন আমরা মাত্র দুইজন লোক কাজ করি। বেচাকেনা নাই। দেনা-পাওনা করে টাকা আইনা দোকানের ভাড়া দেই। আর হয় তো বেশিদিন কারখানা চালাতেই পারবো না।
কারখানা মালিকদের সাথে কথা বলে জানা যায়, আগে হাজীগঞ্জের ৬-৭ টি কারখানায় কাজ করতো শতাধিক শ্রমিক। আর বর্তমানে এই সব কারখানায় সবমিলিয়ে কাজ করছে ১৫-২০ জন শ্রমিক। পর্যাপ্ত কাজ নেই ফলে এই পেশার সাথে জড়িত কেউ কেউ এখন পেশা বদলছেন। আবার কেউ ক্যারাম বোর্ড তৈরির পাশাপাশি অন্য কিছু তৈরি করে টিকে থাকার চেষ্টা করছেন।
কারখানা মালিকরা মনে করেন, তাদের এই অর্থিক সংকট কাটিয়ে উঠতে দরকার পর্যাপ্ত অর্ডার কিংবা অর্থ। যদি সরকারের পক্ষে থেকে কোন অর্থিক সাহায্য কিংবা প্রণোদনা দেওয়া হয়। তবেই কারখানাগুলোর সক্রিয় রাখা সম্ভব হবে। নয়তো কারখানা ভাড়া, শ্রমিকের বেতন দিতে না পেরে অচিরেই বন্ধ হয়ে যাবে তাদের এই কারখানাগুলো।
উল্লেখ যে, আইসিএফের রুলস বুক অনুসারে ক্যারাম বোর্ডের প্রতি বাহুর দৈর্ঘ্য সর্বনিম্ন ৭৩.৫০ সেন্টিমিটার এবং সর্বোচ্চ ৭৮ সেন্টিমিটার। প্রত্যেকটি পকেটের ব্যাস ৪.৪৫ সেন্টিমিটার। ১৯টি ঘুঁটির মধ্যে ৯টি সাদা, ৯টি কালো ও একটি লাল।
প্রতিটি ঘুঁটির ব্যাস ৩.০২ সেন্টিমিটার থেকে ৩.১৮ সেন্টিমিটার এবং ওজন ৫ থেকে ৫.৫০ গ্রামের মধ্যে। স্ট্রাইকারের ব্যাস ৪.১৩ সেন্টিমিটার এবং সর্বোচ্চ ওজন ১৫ গ্রাম। ক্যারামের ঘুঁটিগুলোর রঙ অনুযায়ী পয়েন্ট। লাল রঙের ঘুঁটি, যেটাকে আমরা ‘রেড’ বলি তার পয়েন্ট সবচেয়ে বেশি। এই ঘুঁটিকে অনেক দেশে কুইন বলা হয়। আইসিএফের নিয়ম অনুযায়ীও ‘রেড’কে কুইন বলা হয়।