মোহাম্মদ হাবীব উল্যাহ্:
দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বাড়ির উঠানে, সন্ধ্যা থেকে মধ্য রাত পর্যন্ত বসতঘরের সিঁড়ির পাশে পড়ে ছিল নিহত মোস্তফা কামাল পাটওয়ারীর (৫৫) মরেদহ (লাশ), কিন্তু দাফনে এগিয়ে আসেন নি, বাবা আব্দুল কাদের পাটওয়ারীসহ পরিবারের অন্যান্য লোকজন। আবার স্বামীর উত্তরাধিকার হিসাবে সন্তানদের ন্যায্য হিস্যা (সম্পদ) বুঝে না পাওয়া পর্যন্ত লাশ দাফনে ছিল স্ত্রী জান্নাতুল ফেরদৌস বিউটির আপত্তি।
সোমবার (৬ ফেব্রুয়ারী) দিনভর এমন নাটকীয়তা শেষে এদিন মধ্যরাতে মোস্তফা কামাল পাটওয়ারীর লাশ দাফন করা হয়। হাজীগঞ্জ থানা পুলিশ, স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান, গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ, বাড়ি, স্থানীয় ও এলাকার লোকজনসহ পরিবারের উপস্থিতিতে নিহত মোস্তফা কামাল পাটওয়ারীর স্ত্রী ও সন্তানদের ন্যায্য হিস্যা (সম্পদ) বুঝিয়ে দিবেন বাবা আব্দুল কাদের। এমন সিদ্বান্তের পর লাশ দাফন করা হয়।
এর আগে সোমবার দুপুর ১২ টার দিকে অসুস্থতাজনিত কারণে মারা যান মোস্তফা কামাল পাটওয়ারী। তিনি হাজীগঞ্জ সদর ইউনিয়নের মাতৈন গ্রামের পাটওয়ারী বাড়ির আব্দুল কাদের পাটওয়ারীর ছেলে। মৃত্যুকালে মোস্তফা কামাল পাটওয়ারী স্ত্রী ও দুই ছেলে সন্তান রেখে যান। তিনি মারা যাওয়ার পর সন্তানের অস্বীকৃতি জানিয়ে লাশ দাফনে এগিয়ে আসেন নি বাবা আব্দুল কাদের পাটওয়ারী।
দিনভর বাড়ি ও এলাকার লোকজন বাবা আব্দুল কাদের পাটওয়ারীর মন গলাতে পারেন নি। তিনিসহ তাঁর পরিবারের লোকজন বসতঘরের দরজা-জানালা বন্ধ করে বসে ছিলেন। কারো সাথেই কথা বলেন নি। আবার স্বামীর উত্তরাধিকার সূত্রে সন্তানদের ন্যায্য হিস্যা বুঝে না পাওয়া পর্যন্ত স্বামীর মরদেহ দাফনে আপত্তি জানিয়ে ছিলেন স্ত্রী জান্নাতুল ফেরদৌস বিউটি।
পরে এলাকাবাসী উত্তেজিত হয়ে আব্দুল কাদের পাটওয়ারীর বসতঘরে হামলার চেষ্টা করেন। এসময় বাড়ির লোকজনের বাধায় তারা হামলা না করে মোস্তফা কামাল পাটওয়ারীর মরদেহ বাবার বসতঘরের সিঁড়ির পাশে রেখে দেন। খবর পেয়ে উপজেলায় কর্মরত সংবাদকর্মীরা ওই বাড়িতে উপস্থিত হন। তাঁরা ঘন্টাখানেক চেষ্টা করেও আব্দুল কাদের পাটওয়ারীর সাথে কথা বলতে পারেন নি।
বিষয়টি জানতে পেরে এদিন রাতে হাজীগঞ্জ থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) নাজিম উদ্দীন ও ইউপি চেয়ারম্যান ইউসুফ প্রধানীয়া সুমন ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন। এরপর গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ, বাড়ি, স্থানীয় ও এলাকার লোকজনসহ পরিবারের উপস্থিতিতে নিহত মোস্তফা কামাল পাটওয়ারীর স্ত্রী ও সন্তানদের ন্যায্য হিস্যা (সম্পদ) বুঝিয়ে দিতে রাজী হন বাবা আব্দুল কাদের। এমন সিদ্বান্তের পর লাশ দাফন করা হয়।
বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন, ওই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন যুবলীগের (পূর্ব) সাধারণ সম্পাদক ইউসুফ প্রধানীয়া সুমন। তিনি বলেন, অনেক চেষ্টার পর আব্দুল কাদের পাটওয়ারী রাজি হয়েছেন। আর কোন মামলা-হামলা হবেনা। রাস্তার পাশের ঘরটাতেই তাঁর পুত্রবধু ও নাতিরা থাকবে এবং সম্পদের হিস্যা অনুযায়ী তিনি তাদেরকে (পুত্রবধু ও দুই নাতি) বুঝিয়ে দিবেন।
এরপর এদিন রাতে (সোমবার দিবাগত রাত ১২ টার পর) নিহত মোস্তফা কামাল পাটওয়ারীর জানাযা শেষে দাফন সম্পন্ন করা হয়। জানাযার পূর্বে বক্তব্য রাখেন, স্থানীয় ইমাম, ইউপি চেয়ারম্যান, নিহতের ভাইসহ অন্যান্যরা। জানাযার ইমামতি করেন, নিহত মোস্তফা কামাল পাটওয়ারীর ছোট ছেলে হাফেজ মো. জাবেদ হোসেন পাটওয়ারী।
উল্লেখ্য, সোমবার সংবাদকর্মীদের নিহত মোস্তফা কামাল পাটওয়ারীর স্ত্রী জান্নাতুল ফেরদৌস বিউটি জানান, প্রায় ২৩ বছর পূর্বে পারিবারিকভাবে তাদের বিয়ে হয়। কিন্তু তিনি কালো হওয়ায় তাঁর শশুর-শাশুড়ী সব সময় তাকে নির্যাতন করতেন। বিশেষ করে শাশুড়ী ও ননদদের অত্যাচারে তিনি অতিষ্ঠ ছিলেন। এ বিষয়ে স্বামীকে জানালে তিনি (মোস্তফা কামাল পাটওয়ারী) ধৈর্য্য ধরার কথা বলতেন।
তিনি বলেন, ২০০০ সালের দিকে আমার বাবার বাড়ির লোকজনের টাকা-পয়সা খরচ করে আমার স্বামীকে বিদেশ পাঠাই। তিনি বিদেশ যাওয়ার পর সব টাকা আমার শশুরের নামে পাঠাতেন। সেই টাকা দিয়ে শশুরসহ আমার সংসার খরচ চলতো এবং আমার স্বামীর টাকা দিয়ে অনেক সম্পদ শশুরের নামে কেনা হয়েছে। তবুও আমি শশুর-শাশুড়ি ও ননদদের মন জয় করতে পারেনি।
এক পর্যায়ে আমার স্বামী অসুস্থ হয়ে দেশে চলে আসেন। কিন্তু দেশে আসার পর আমার শশুর ও ননদেরা আমার স্বামীর চিকিৎসা না করিয়ে আমাদেরকে ঘর থেকে বের করে দেয়। আমি আমার বাবার বাড়ির সহযোগিতায় তাকে চিকিৎসা করাই। এরপর তিনি গুরুতর অসুস্থ হলে আমি মেজর অব. রফিকুল ইসলাম বীরউত্তম এমপি স্যারকে জানাই এবং পরবর্তীতে স্যারের সহযোগিতায় আমার স্বামীকে ঢাকায় চিকিৎসা করায়।
তিনি কান্নাজড়িত কন্ঠে বলেন, এর মধ্যে তারা (শশুর ও ননদেরা) এক টাকাও দেয়নি। অথচ আমার স্বামীর টাকা দিয়ে সম্পদ কিনছে, বাড়ি-ঘর করছে। জীবিকা নির্বাহ করেছে। আজ (সোমবার) চিকিৎসারত অবস্থায় আমার স্বামী মৃত্যুবরণ করলে লাশ দাফন করার জন্য বাড়ীতে আনি। কিন্তু আমার শশুর কবরস্থানে লাশ দাফন করতে দিবেনা বলে বাঁধা দেয়। তিনি জানান, আমার স্বামী তাঁর সন্তান নয়।
এসময় তিনি আরো বলেন, আমার স্বামী জীবিত থাকতে আমার দুই ছেলে ও আমাকে বাড়ি-ঘর থেকে বের করে দিয়েছে। এখন আবার স্বামীর লাশ দাফন করতে দিচ্ছেন না আমার শশুর। তাহলে আমার সন্তানদের ভবিষৎ কি, তারা কোথায় থাকবে? তাই ন্যায্য হিস্যা ছাড়া আমিও আমার স্বামীর লাশ দাফন করতে দিবো না। কারণ, আমার সন্তানদের কি উপায় হবে?
এ দিকে সংবাদকর্মীরা পাটওয়ারী বাড়ীতে ঘন্টাখানেক সময় অবস্থান করেও নিহতের বাবা আব্দুল কাদের পাটওয়ারী ও তাঁর বোনদের বক্তব্য নিতে পারেনি। আব্দুল কাদের পাটওয়ারী পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের নিয়ে পাকা বসতঘরের দরজা-জানালা বন্ধ করে ঘরের ভেতরেই অবস্থান করছিলেন। সংবাদকর্মীরা ও এলাকার লোকজন ডাকাডাকি করলেও কেউই ঘরের দরজা খোলেন নি।
তবে নিহতের ভাই স্বপন বলেন, কামালের প্রসঙ্গে আমি কিছুই বলতে পারবোনা। এ সময় পাটওয়ারী বাড়ীর নুরুল আলম পাটওয়ারীসহ বাড়ীর অন্যান্য ও এলাকার লোকজন নিহত মোস্তফা কামাল পাটওয়ারীর বাবা আব্দুল কাদেরের বিরুদ্ধে বক্তব্য দেন। তারা জানান, তিনি (আব্দুল কাদের) খুবই ধূর্তপ্রকৃতির লোক।
এক পর্যায়ে এলাকাবাসী ক্ষিপ্ত হয়ে আব্দুল কাদেরের ঘরে হামলার করার চেষ্টা করে। পরে বাড়ীর লোকজনের সহযোগিতায় উত্তেজিত গ্রামবাসিকে বাঁধা প্রদান করা হয়। এসময় তারা নিহত মোস্তফা কামাল পাটওয়ারীর মরদেহ তার বাবার বসতঘরের দরজার সামনে নিয়ে রাখে। এ সংবাদ লেখা পর্যন্ত রাত ১০টা মোস্তফা কামাল পাটওয়ারীর মরদেহ বাড়ীর উঠানেই পড়েছিল।
স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান ইউসুফ প্রধানীয়া সুমন সংবাদকর্মীদের জানান, ঘটনাস্থলে হাজীগঞ্জ থানার এসআই (উপ-পরিদর্শক) মো. নাজিম উদ্দিন ঘটনাস্থলে অবস্থান করছেন।
তিনি বলেন, নিহতের স্ত্রী ও সন্তানের দাবীর প্রেক্ষিতে তাদেরকে থাকার জন্য কামালের ক্রয়কৃত সোয়া ৯ শতাংস জমি স্ত্রী বা তার ছেলেদের নামে দেয়া হবে। এই মর্মে রাতেই একটি স্ট্যাম্প করা হবে। মৃত কামালের বাবা আবদুল কাদেরকে কামালের স্ত্রী ও সন্তানদের নামে এ জমি দিতে রাজি হয়েছে। সেই অনুযায়ী কাজ চলছে।