হাজীগঞ্জে দালাল চক্রের কাছে জিম্মি তরমুজ চাষীরা। চোখের সামনেই নষ্ট হচ্ছে শতশত তরমুজ। ফেলে দিতে হচ্ছে ডাকাতিয়া নদীতে। এতে বেপক আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন তরমুজ চাষিরা।
প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে ট্রলার বোঝাই করে নৌপথে চাষিরা তরমুজ নিয়ে আসে চাঁদপুর জেলার সবচেয়ে বড় তরমুজের আড়ত হাজীগঞ্জ বাজারে।
এখান থেকে পাইকারি ব্যবসায়ীরা ট্রাকে করে তরমুজ নিয়ে যায় লাকসাম,কুমিল্লা, ফেনী, নোয়াখালী, সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে।
এখানকার আড়তগুলোতে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে তরমুজ বেচাকেনা। আর এই তরমুজ বেচাকেনাকে কেন্দ্র করে আড়তগুলোতে প্রতিদিন লেনদেন হয় কোটি কোটি টাকা।
তবে বিগত বছরের তুলনায় ট্রলারভর্তি তরমুজের চালান নিয়ে এসে কাঙ্খিত দাম না পেয়ে এবার হতাশ তরমুজ বিক্রেতারা।
তরমুজ চাষিরা জানান, এবার বৃষ্টিতে তরমুজের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। তরমুজের গায়ে দাগ লেগে পঁচে গেছে। এছাড়া হাজীগঞ্জে নিয়ে আসার পথে ট্রলারেও অনেক তরমুজ নষ্ট হয়েছে। তার উপর এখানে দালালদের কথা ছাড়া আড়ৎ ব্যবসায়ীরা ট্রলার থেকে তরমুজ তুলছে না। যার কারণে তরমুজ নিয়ে আসা ব্যবসায়ীরা দালালদের কাছে জিম্বি হয়ে দু তিন দিনেও ট্রলার থেকে আড়তে তরমুজ তুলতে না পারার কারনে ট্রলারে থেকেই তরমুজ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। নষ্ট তরমুজ ফেলে দিতে হচ্ছে ডাকাতিয়া নদীতে।
আর দালাল চক্রের কবলে পড়ে অবশিষ্ট তরমুজ কম দামে বিক্রয় করতে হচ্ছে। এতে আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে তরমুজ চাষীরা।
অন্যদিকে ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, কিছু তরমুজে দাগ, ফোটা, তরমুজ পরিপক্ব না হওয়ায় ক্রেতারা তরমুজ কিনতে চাচ্ছেন না।
সরেজমিনে তরমুজ আড়তে গিয়ে দেখা যায়, তরমুজবোঝাই ট্রলারগুলো ডাকতিয়া নদীর পাড়ে নোঙর করা আছে। চাষি আর আড়তদারদের মধ্যে দর কষাকষি চলছে। শ্রমিকরা ব্যস্ত ট্রলারের পর ট্রলার তরমুজ খালি করতে। এ সময় হাজার হাজার নষ্ট তরমুজ পড়ে থাকতে দেখা যায় ডাকাতিয়া নদীর পাড়ে।
ভোলা থেকে তরমুজ নিয়ে আসা ইউসুফ আলী চিশতী বলেন, আমি গত ৩ দিন আগে ট্রলারে করে তরমুজ নিয়ে এসেছি, এখন পর্যন্ত আমার ট্রলার থেকে তরমুজ আনলোড হচ্ছে না। আমার ট্রলারে প্রায় সাড়ে ৬ হাজার তরমুজ রয়েছে। তিনি আরো বলেন, এখানে দালাল চক্র ও আড়তদারদের কাছে জিম্বি হয়ে আছে তরমুজ চাষীরা। আর যথা সময়ে ট্রলার থেকে তরমুজ আড়তে তুলতে না পারলে ট্রলারেই অনেক তরমুজ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আর সেই তরমুজই নদীতে ফেলে দিতে হচ্ছে। তিনি আরো বলেন, আমরা যারা দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে হাজীগঞ্জে তরমুজ নিয়ে আসি আমাদেরকে এখানকার প্রশাসন সহযোগীতা করা প্রয়োজন। কারন এখানে আমরা এসে দালালের চক্রে পড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি।
ভোলা থেকে তরমুজ নিয়ে আসা ইসমাইল বলেন, এবার মোট ১২ একর জমিতে তরমুজ চাষ করি। প্রথমেই তিন একর জমির তরমুজ পোকার কারণে নষ্ট হয়ে গেছে। বাকি ৮ একর জমির তরমুজের মধ্যে গত কয়েক দিনে বৃষ্টির কারণে তরমুজে গায়ে দাগ লেগে গেছে। এতে পাকা তরমুজগুলো পঁচে যাচ্ছে। আগে পাইকাররা জমি থেকে তরমুজ কিনতেন। এ বছর বৃষ্টি হওয়ায় পাইকারও পাচ্ছি না। এজন্য ট্রলারে করে চাঁদপুরের হাজীগঞ্জে নিয়ে এসেছি। এখানে আট হাজার পিস তরমুজ নিয়ে আসি। কিন্তু তরমুজগুলো আনার পথে গরমের কারণে ট্রলারে তিন হাজার তরমুজ নষ্ট হয়ে গেছে। সেগুলো ডাকাতিয়া নদীতে ফেলে দিয়েছি। বর্তমানে পাঁচ হাজার তরমুজ বিক্রয় করছি।
তিনি আরও বলেন, এখানে বড় সাইজের তরমুজের দাম প্রতি শ ১২ থেকে ১৩ হাজার টাকা, ছোট সাইজের তরমুজ ৬ থেকে ১০ হাজার টাকার মধ্যে বিক্রয় করছি। জমিতে যে পরিমাণ তরমুজ আছে সেগুলো প্রায় পাঁচ লাখ টাকা বিক্রয় করতে পারব। তরমুজ উৎপাদনের জন্য ১৮ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। এবছর ১০ থেকে ১২ লাখ টাকা ক্ষতি হবে।
পটুয়াখালী থেকে আসা তরমুজ চাষি বিপ্লব চৌধুরী বলেন, বৃষ্টি ও শিলাবৃষ্টিতে তরমুজ নষ্ট হয়ে গেছে। আমি পাঁচ একর জমিতে তরমুজ চাষ করেছি। এতে প্রায় ১২ থেকে ১৩ লাখ টাকার মতো খরচ হয়েছে। এ বছর চাষের অনুপাতে তরমুজ বিক্রয় হচ্ছে না। আগে ক্ষেতে যেত ব্যাপারীরা। এ বছর বৃষ্টি হওয়ার পর থেকে ক্ষেতে কোনো ব্যাপারী আসছে না। যার কারণে হাজীগঞ্জে তরমুজ নিয়ে এসেছি। এখানে তরমুজ বিক্রয় তেমন একটা ভালো হচ্ছে না। অনেক টাকা ঋণ আছে। ভেবেছিলাম তরমুজ বিক্রয় করে ঋণ পরিশোধ করবো। কিন্তু এখন দেখি তা আর হচ্ছে না।
হাজীগঞ্জ আড়তের পাইকারি ব্যবসায়ী গরীবের বন্ধু আড়তের পরিচালক মো. সোহাগ ব্যাপারী জানান, বৃষ্টিতে তরমুজের প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এতে চাষি-ব্যবসায়ীদের প্রচুর লোকসান হবে। বৃষ্টিতে তরমুজ নষ্ট হওয়ার কারণে সামনে তরমুজের দাম বাড়বে।
হাজীগঞ্জ বাজারের স্থানীয় খুচরা বিক্রেতা আবু হেলা বাবলু বলেন, বৃষ্টিতে তরমুজ নষ্ট হয়ে গেছে। আমরা পাইকারি কিনে এনে ক্রেতা না থাকার কারণে লোকসান দিচ্ছি।
দালালদের খপ্পর থেকে বাঁচতে হাজীগঞ্জ উপজেলা প্রশাসনের সহযোগিতা কামনা করেন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা তরমুজ চাষিরা।