আসন্ন ঈদকে সামনে রেখে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ের জামদানি পল্লিগুলোতে কারিগর ও শিল্পীরা শাড়ি তৈরির কাজে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন। তাদের মধ্যে কেউ কেউ কাপড়ে সুতা তুলছেন, সুতা রং করছেন, কেউ শাড়ি বুনছেন আবার কেউ শাড়িতে নকশার কাজ করছেন। এখানকার পল্লি এলাকাগুলোতে রাজধানী ঢাকাসহ আশপাশের এলাকার ক্রেতারা প্রতিদিনই ভিড় জমাচ্ছেন। ক্রেতা ও বিক্রেতাদের হাঁকডাকে এবার খুশি তাঁতিরা।
উপজেলার চৌরাপাড়া, মুছারচর, আলমদীচরভুলা, মালিপাড়া, সাদিপুর, ব্রাহ্মণবাওগাঁ, খেজুরতলা, কাজিপাড়া, শেকেরহাট, বাসাবো, তিলাব, বস্তল, কলতাপাড়া, কাহেনা, গনকবাড়ি, ওটমা, রাউৎগাঁও, নয়াপুর, উত্তর কাজিপাড়া, চেঙ্গাইন, খালপাড় চেঙ্গাইন, ভারগাঁও, কান্ধাপাড়া, ফিরিপাড়া, বাইশটেকি, আদমপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় এখন জামদানিসহ দেশীয় শাড়ি তৈরির কাজ চলছে বেশ জোরেশোরে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এ বছর রমজানের প্রথম থেকেই গত ৩/৪ বছরের তুলনায় জামদানি দ্বিগুণ বেচাকেনা হয়েছে। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ক্রেতারা এসে অগ্রিম মূল্য দিয়ে নিজেদের পছন্দের শাড়ির কথা জানিয়ে যান। এরপর তাদের চাহিদা অনুযায়ী জামদানি শাড়ি তৈরি করেন কারিগররা। এখানকার জামদানি শাড়ির ব্যাপক চাহিদা থাকায় অনলাইনে আমেরিকা, ইংল্যান্ড, ভারত, নেপালসহ অনেক দেশে বিক্রি হয়। তার মধ্যে প্রকারভেদে ৩ হাজার থেকে শুরু করে ১ লাখ টাকা দামের শাড়ি রয়েছে। এ ছাড়া থ্রি-পিস ১ হাজার ২০০ টাকা থেকে শুরু করে ৩ হাজার টাকা এবং পাঞ্জাবি ১ হাজার টাকা থেকে বিভিন্ন দামের রয়েছে।
মালিপাড়া এলাকার জামদানি পল্লির মালিক শুক্কুর আলী জানান, আগে অনেক জামদানি বিক্রি হতো। তবে গত দুই-তিন বছরে তেমন একটা বেচা হয়নি। তিনি আশা করেন, এ বছর জামদানি ভালো বিক্রি হবে। জামদানি বেচার টাকা দিয়ে গরুর খামার করবেন এবং মেয়ের বিয়ে দিবেন।
বাইশটেকি গ্রামের জামদানির কারিগর শামীম মিয়া বলেন, ‘ভারতীয় নকল জামদানি বাজারে ছড়িয়ে পড়েছে। তাই আসল জামদানির কদর থাকলেও এখন ন্যায্য মজুরি না পাওয়ায় অনেকেই এ পেশা ছেড়ে দিয়েছেন। সরকারের কাছে আমাদের আবেদন, যেন জামদানি কারিগরদের দিকে নজর দেন।’
জামদানি পল্লির কয়েকজন তাঁতির সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সূক্ষ্ম নকশাদার কাজ দিয়ে তৈরি ঐতিহ্যবাহী জামদানি শাড়ির চাহিদা শুধু দেশে নয়, বিদেশেও। তবে তাঁতশিল্পীরা বর্তমানে জামদানি শাড়ির পাশাপাশি সালোয়ার-কামিজসহ ছেলেদের জন্য পাঞ্জাবিও তৈরি করছেন। শাড়ি তৈরিতে নকশার প্রকারভেদে সাধারণত এক সপ্তাহ থেকে এক মাস পর্যন্ত সময় লাগে। উৎপাদনের ভিত্তিতে শাড়ির প্রকারভেদ অনুযায়ী কারিগরদের মজুরি দেওয়া হয়। যেমন ১০ হাজার টাকা দামের একটি শাড়ি তৈরি করতে দুজন কারিগর কাজ করে থাকেন। তাদের মজুরি বাবদ ৯ হাজার টাকা দেওয়া হয়।
বাইশটেকি গ্রামের জামদানি পল্লিতে ঢাকা থেকে শাড়ি কিনতে আসা আকলিমা আক্তার জানান, ব্যবসায়িক প্রয়োজনে তিনি প্রায়শই সোনারগাঁয়ের জামদানি পল্লিগুলোতে আসেন। ঢাকাতে তার একটি দোকান আছে। ক্রেতাদের চাহিদা অনুযায়ী প্রতিবছরের ন্যায় এবারও তিনি পাইকারি দরে জামদানি শাড়ি, সালোয়ার-কামিজ ও পাঞ্জাবি কিনতে এসেছেন। তিনি জানান, এবার জামদানির প্রতি ক্রেতাদের প্রচুর চাহিদা রয়েছে। করোনার প্রাদুর্ভাবের কারণে গত ৩-৪ বছর ক্ষতির সম্মুখীন হলেও এবার তা পুষিয়ে নেওয়ার চেষ্টায় আছেন।
বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন জাদুঘরের উপ-পরিচালক এ কে এম আজাদ সরকার জানান, প্রতিবছরই ফাউন্ডেশনের ভেতরে মাসব্যাপী লোক ও কারুশিল্প মেলায় জামদানি শাড়ি কেনাবেচার জন্য বিশেষভাবে দোকান বরাদ্দ দেওয়া হয়। এ ছাড়া বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন জাদুঘরের ভেতরে জামদানি পল্লি রয়েছে, যেখানে সারা বছরই জামদানি শাড়ি, সালোয়ার-কামিজ, ফতুয়া ও পাঞ্জাবি পাওয়া যায়। সোনারগাঁয়ের ঐতিহ্য ও গৌরব ধরে রেখেছেন জামদানি শিল্পীরা।
সোনারগাঁ জামদানি তাঁতি সমিতির সভাপতি মো. সালাউদ্দিন বলেন, ‘করোনা মহামারির ধাক্কা সামলে এ বছর আমাদের ব্যবসা কয়েক গুণ বেড়েছে। আসন্ন ঈদকে কেন্দ্র করে কারিগররা ব্যস্ত সময় পার করছেন। ব্যবসায়ীরা অতিরিক্ত মুনাফা লাভের আশায়, নানা রংবেরঙের শাড়ি দোকানে তুলেছেন। এই ঈদে আশা করি সোনারগাঁ জামদানি পল্লিতে প্রায় ৪০ থেকে ৫০ কোটি টাকার বেচাকেনা হবে।’
সোনারগাঁ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফারজানা রহমান জানান, জামদানি পল্লিগুলো সোনারগাঁয়ের একটি ঐতিহ্য ও অস্তিত্ব। এ পেশায় জড়িতদের সহজশর্তে ঋণ ও সরকারিভাবে আর্থিক সহযোগিতাসহ নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার চেষ্টা করছেন।