কয়েকদিন পরই পবিত্র ঈদুল ফিতর। কিন্তু আনন্দের রেশ নেই চাঁদপুরের প্রায় ৫০ হাজার জেলে পরিবারে। জাটকা রক্ষায় দুই মাস (মার্চ-এপ্রিল) নদীতে মাছ ধরা বন্ধ। তাই সন্তানদের জন্য নতুন পোশাক কিনতে পারছেন না তারা। এমনকি ঈদের দিন চিনি-সেমাই কেনারও সামর্থ্য নেই অনেকের।
কেউ কেউ আশা করছেন, ঈদের আগে দু’একদিন ইলিশ ধরতে পারলে বিক্রি করে খরচটা চালানো যেতো। কিন্তু সে সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।
স্থানীয় প্রশাসন জানিয়েছে, ঈদ উপলক্ষে বিপুল সংখ্যক জেলেকে সহযোগিতা করা আপাতত সম্ভব না হলেও কয়েকশ অতিদরিদ্র জেলেকে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে ঈদ উপহার দেওয়া হয়েছে।
নদীর পাড় ঘুরে দেখা গেছে, মাছ ধরা বন্ধ থাকায় বেকার সময় পার করছেন অধিকাংশ জেলে। আগামী ১ মে থেকে মাছ ধরা শুরু হবে। তাই অনেকে আবার জাল সেলাই এবং নৌকা মেরামতের কাজে ব্যস্ত।
মতলব উত্তর উপজেলার এখলাছপুর এলাকার জেলে মফিজল সরকার বলেন, ‘গত বছরগুলোতে মাছ ধরেই যে উপার্জন করেছি, তা দিয়ে কোনোরকম সংসার চলেছে। ঈদে ছেলেমেয়ে, বাবা-মাকে নতুন কাপড় দিয়েছি। তবে এবারের ঈদে সমস্যার মধ্যে আছি। ঈদের আর মাত্র কয়েকদিন আছে, এখনও জামা-কাপড় কিনতে পারিনি। ঘরে বাচ্চারা কান্নাকাটি করে। আমরা তো গরিব মানুষ। ৫-১০ হাজার টাকা খরচ করে ঈদের বাজার করার সামর্থ্য নেই। সেমাই-চিনি কিনতেই কষ্ট হয়ে যাচ্ছে। নদীতে মাছ ধরতে পারলেই কেবল সেমাই-চিনি, সন্তান ও নিজেদের জন্য কাপড় নিতে পারতাম।’
একই এলাকার জেলে সুমন সরদার বলেন, ‘সরকার দুই মাসের নিষেধাজ্ঞা দিছে, আমরা তা পালন করছি। সরকার যে সহযোগিতা দেয় তা আমি পাই না। আমরা খাইয়া, না খাইয়া খুব কষ্টে দিন কাটাইতাছি। গত এক সপ্তাহের বেশি আমাগো সংসার চলে না। বউ-পোলাপাইন নিয়া খাইয়া-না খাইয়া আছি। আমাগো কোনও কামকাজ নাই। এমন একটা ঈদ আইতাছে, কিন্তু কিছু করার আমাগো পক্ষে সম্ভব না। তিন-চারটা বাচ্চা স্কুল-মাদ্রাসায় পড়াই, তাদের পড়ালেখাও বন্ধ। বেতন দিতে পারি না। আমরা খুব অসহায় অবস্থার মধ্যে আছি। সরকার কিছু সাহায্য দিলে উপকার হইতো।’
বৃদ্ধ জেলে সাহেব আলী বলেন, ‘৫০ বছর ধরে নদীতে জাল বাই। কিন্তু এই বছরের মতো এমন অবস্থা দেখি নাই। আমার চার মেয়ে এক ছেলে। মেয়েগো স্কুল বন্ধ, ছেলের মাদ্রাসা বন্ধ। রুজি নাই, পড়ামু কি দিয়া? মাস্টারতো আগে চাইবো বেতন। বেতনের টাকা না দিতে পারলে পিডায়। আর কিস্তির টাকাতো দিতেই হয়। সেদিন কিস্তির টাকা দেওয়ার জন্য ঘরের ছয় খান টিন বেইচ্চা দিছি। এখন ভাত যে খামু হেই টাকাও নাই। তাই ঈদে আমাগো কোনও উপায় নাই। একটা গেঞ্জি কেনার মতো অবস্থা নাই। এমন আরও অনেক জাউল্লা আছে, বেকের (সবার) একই অবস্থা।’
জেলে বশির হোসেন বলেন, ‘আমরা নদীর ওপর নির্ভরশীল। পোলাপাইনের লেখাপড়ার খরচ, সংসার খরচ দিয়াই আমরা কুলাইতে পারি না। পোশাক, টাকা-পয়সা এসব পোলাইপাইনকে আমরা দিতে পারি না। তারপরও বাচ্চাদের মুখে দিকে তাকিয়ে ঋণ করে লুঙ্গি-জামা দিছি। হয়তো চিনি-সেমাই মিলবে। কিন্তু ঈদের দিনের জন্য এক কেজি মাংস কিনতে পারবো না। কারণ, এক কেজি মাংস কিনতে ৭৫০ টাকা লাগবে।’
জেলে সোহেল বলেন, ‘ঈদ আইয়া পড়ছে। কিন্তু এখনও বাচ্চাদের জামা-কাপড় দিতে পারি না। নদীতে নামতে পারলে হয়তো কিছু দিতে পারতাম। এবারের ঈদে নিজেও কিছু নিতে পারমু না, তাগও কিছু দিতে পারমু না। চলতেই তো কষ্ট হইতাছে। আমাদের কাছে টেকা-পইসা নাই, চিনি-সেমাই এগুলো মনে হয় এবার আমাগ কপালে জুটবো না।’
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. গোলাম মেহেদী হাসান বলেন, ‘চাঁদপুরে ৪৪ হাজার ৩৫ জন নিবন্ধিত জেলে রয়েছে। এটা বড় সংখ্যক কমিউনিটি। এখানে তো এক-দুইশ লোক না। তবে সরকার সাধ্যমতো চেষ্টা করছে। জেলেদের বিকল্প আয়বর্ধকমূলক উপকরণ হিসেবে সেলাই মেশিন, ছাগল, গরু ও পরিবেশবান্ধব জালসহ বিভিন্ন উপকরণ দেওয়া হয়েছে। তাদের জীবনমান উন্নয়নের জন্য এগুলো করা হচ্ছে। ভিজিএফ কর্মসূচির আওতায় নিবন্ধনকৃত প্রত্যেক জেলেকে প্রতি মাসে ৪০ কেজি করে চার মাসে ১৬০ কেজি চাল দেওয়া হয়। চালের অর্ধেক ইতোমধ্যে মাঝে বিতরণ করা হয়েছে। বাকি দুই মাসের চাল সহযোগিতা ঈদের আগেই দেওয়া হবে।
চাঁদপুরের জেলা প্রশাসক কামরুল হাসান বলেন, বর্তমান সরকার জেলেদের চাল, বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাসহ বিভিন্ন সময় সহযোগিতা করছে। ঈদকে সামনে রেখে ইতোমধ্যে জেলেদের প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে ঈদ উপহার দেওয়া হয়েছে। সবাইকে দেওয়া সম্ভব হয়নি। তবে যারা খুব দরিদ্র তাদেরকে ঈদ উপহার দেওয়া হয়েছে। এছাড়া নিবন্ধিত সব জেলেকে ঈদের আগেই সরকারি চাল সহায়তা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। তাদের সহায়তা বাড়ানোর বিষয়টি সরকারিভাবে চিন্তা করতে হবে।