রিয়াজ শাওনঃ
হাজিগঞ্জ উপজেলার ৫ নং হাজিগঞ্জ সদর ইউনিয়নের ১ নং ওয়ার্ড কাজিরগাঁও গ্রামের পূর্ব কাজিরগাও বিলে সরকারি হালটের উপরে তৈরি করা হয়েছে নতুন সড়ক। তবে ইতিমধ্যে সড়কটি নিয়ে স্থানীয় জনমনে সৃষ্টি হয়েছে নানা প্রশ্ন।
অনেকের দাবি স্থানীয় প্রভাবশালী ভূমি ক্রয় বিক্রয় সিন্ডিকেটের সুবিধায় নির্মাণ করা হয়েছে এই সড়ক। এতে সহযোগিতা করেছে স্থানীয় চেয়ারম্যান ও উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও)।
সরজমিন গিয়ে দেখা যায়, হাজীগঞ্জ-কচুয়া সড়কের পাশে শুরু হয়ে রাস্তাটি বিলের মাঝে গিয়েই শেষ হয়ে গেছে। এই রাস্তাটির চারপাশে কোন ঘরবাড়ির দোকান কিংবা কোন প্রতিষ্ঠান নেই। প্রশ্ন হচ্ছে তাহলে বিলের মাঝে কেন এই নতুন রাস্তা তৈরি করা হলো? আর কেই বা এই রাস্তা তৈরি করলো ?
এই প্রশ্নের উওর খোঁজতে সরজমিন গিয়ে স্থানীয় বাসিন্দা ও বিলের কৃষকদের সাথে কথা বলে জানা যায়। মাসখানিক আগে এই রাস্তাটি সরকারি অর্থে সরকারি হালট এর উপর তৈরি করেছে স্থানীয় মেম্বার জসিম । মাত্র ৩-৪ দিনে ভ্যাকু দিয়ে তৈরি করেছে রাস্তাটি।
স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, ভূমি সিন্ডিকেটের সুবিধা দিতেই তৈরি করা হয়েছে রাস্তাটি। এছাড়াও ভূমি সিন্ডিকেটের কাছে থেকে মোটা অংকের অর্থও নাকি নেওয়া হয়েছে এই রাস্তাটি তৈরি করার জন্য । কারন এই রাস্তাটি তৈরি হলে এই বিলের ভূমি সিন্ডিকেটদের ক্রয় করা জমির দাম বেড়ে যায় কয়েকগুণ। এতে অতিরিক্ত দামে বিক্রি করতে পারবে জমি। তাই বিলের মাঝে এই মুহূর্তে স্থানীয়দের এই রাস্তাটি দরকার না হলেও শুধু মাত্র ভূমি সিন্ডিকেটের সুবিধা দিতেই সরকারি হালটের উপর সরকারি অর্থে রাস্তাটি তৈরি করা হয়েছে।
ঘরবাড়িহীন এমন একটি বিলে হঠাৎ কেন এই রকম একটি রাস্তা তৈরি করা হয়েছে? আর সরকারি কোন প্রকল্পের আওতায়ই বা তৈরি করা হয়েছে এই রাস্তাটি? আর কত টাকাই বা বরাদ্দ হয়েছিলো এই রাস্তার জন্য ?
এই সব প্রশ্নের উত্তর জানতে দুইদিন ৫নং হাজীগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদের সচিব সোলেমান মিয়ার কাছে গেলেও তিনি কোন তথ্য দিতে রাজি হননি। তিনি জানান, শুধু মাত্র চেয়ারম্যান বলেই তিনি তথ্য দিবেন। এই বিষয়ে চেয়ারম্যানের সাথে যোগাযোগ করলে তিনিও কোন তথ্য দিতে রাজি হয়নি। তিনি পিআইও’র সাথে যোগাযোগ করতে বলে। পিআইওর সাথে যোগাযোগ করলেও তিনিও কোন তথ্য দিতে রাজি হয়নি।
তবে বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, সরকারি ২০২২-২০২৩ অর্থবছরের অতিদরিদ্রদের জন্য কর্মসংস্থান কর্মসূচিতে (ইজিপিপ) যা সবার কাছে ৪০ দিনের কর্মসূচি হিসেবে পরিচিত এই প্রকল্পের আওতায় তৈরি করা হয়েছে এই রাস্তাটি। যদি সত্যিই এই প্রকল্পের আওতায় রাস্তাটি তৈরি করা হয়। হলে অতিদরিদ্রদের কর্মসংস্থান কর্মসূচির নীতিমালার নূন্যতম শর্তও পূরণ করেনি প্রকল্প কমিটি।
কারন অতি দরিদ্রদের জন্য কর্মসংস্থান কর্মসূচি বাস্তবায়ন নীতিমালায় যেখানে বলা হয়েছে। “জেলা কর্ণধার কমিটির চূড়ান্ত অনুমোদনের পর শ্রমিকদের জবকার্ড এবং প্রকল্পের সাইনবোর্ড প্রস্তুত করা হয়। প্রকল্প তদারকির জন্য উপজেলা কর্মকর্তাদের ইউনিয়নওয়ারী ট্যাগ অফিসার হিসেবে নিয়োগ করে প্রকল্পস্থলে সাইনবোর্ড স্থাপনপূর্বক প্রকল্পের কাজ আরম্ভ করা হয়।
কিন্তু সরজমিনে ১৫,১৮,২০ জানুয়ারি তারিখে গিয়েও এই প্রকল্পের আশেপাশে কোথাও সাইনবোর্ড টানানো দেখা যায়নি।
এছাড়াও, অতি দারিদ্র্য কর্মসংস্থান কর্মসূচির নীতিমালায় আরো বলা আছে, ” প্রকল্প পরিচালক কর্তৃক প্রদত্ত বরাদ্দের আলোকে বিল প্রস্তুত করে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক একাউন্টে (মাদার একাউন্ট) অর্থ জমা করা হয়। শ্রমিক তালিকা অনুযায়ী ইউনিয়নওয়ারী শ্রমিকদের মজুরি পরিশোধের জন্য ব্যাংকের শাখা নির্বাচন করে প্রত্যেক শ্রমিকের নামে ব্যাংক হিসাব খোলা হয় এবং মাদার একাউন্ট হতে নির্ধারিত ব্যাংকের শাখায় (চাইল্ড একাউন্ট) টাকা স্থানান্তর করা হয়।
কিন্তু সরজমিনে অনুসন্ধান করে স্থানীয় বাসিন্দাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, রাস্তাটির মাটি কাটা হয়েছে ভ্যাকু দিয়ে । এছাড়াও ভ্যাকু দিয়ে মাটি কাটার স্পষ্ট প্রমাণ আশেপাশে লক্ষ্য কার গেছে । প্রশ্ন হল যেখানে ইজিপিপ প্রকল্পের মূল লক্ষ্য হলো দারিদ্র মানুষের কর্মসংস্থান তৈরিরা। গ্রামের বেকার দারিদ্র্য শ্রমিকরা এই রাস্তা তৈরির কাজ কারবে । এবং তাদের নামের ব্যাংক একাউন্টে দৈনিক ৪০০ টাকা হারে ৪০ দিনের ১৬ হাজার টাকা জমা দেওয়া হবে। সেখানে ভ্যাকু দিয়ে মাটি কাটার ফলে সরকারের উদ্দেশ্য ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি স্থানীয় শ্রমিকরাও কাজ করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছে।
এছাড়াও অভিযোগ রয়েছে চাওড়া করার কথা তেমন চওড়া হয়নি। তবে সাপ্তাহখানিক ধরে এই রাস্তা নিয়ে আমাদের অনুসন্ধানের খবর পেয়ে দ্রুতগতিতে রাস্তাটি আবার কেটে চওড়া করা হচ্ছে।
অনুসন্ধানের জানা যায় , এই রাস্তা তৈরির প্রকল্পটির সভাপতি ছিলেন ১নং ওয়ার্ড মেম্বার জসিম।
এই বিষয়ে তার কাছে জানতে মুঠোফোন কথা হয়। তিনি বলেন, কোন প্রকল্পের আওতায় এ রাস্তা তৈরি করা হয়েছে আমি জানি না। এবিষয়ে চেয়ারম্যানের সাথে কথা বলেন। আমাকে প্রকল্পের সভাপতি করা হয়েছে আমি শুধু কাজ করছি।
তার কাছে জানতে চাওয়া হয়? রাস্তাটির আশেপাশে তো কোন ঘরবাড়ি দোকানপাট কিংবা কোন প্রতিষ্ঠানেই তাহলে কেন এই রাস্তাটি তৈরি করা হয়েছে? তিনি বলেন, এলাকার বিভিন্ন মানুষ চেয়ারম্যানের কাছে এই রাস্তাটি তৈরি করার জন্য আবেদন করেছে। রাস্তাটি হলে তারা এখানে বাড়িঘর করবে। তাই চেয়ারম্যান এ রাস্তাটি তৈরি করেছে। তবে ভূমি সিন্ডিকেটের সুবিধা দিতে রাস্তাটি তৈরি করার বিষয়টি তিনি অস্বীকার করেন।
তার কাছে আরো জানতে চাওয়া হয়, আমরা শুনেছি এই রাস্তাটি ইজিপিপ প্রকল্পের আওতায় তৈরি করা হয়েছে। যদি তাই হয় তাহলে কেন শ্রমিকের পরিবর্তে ভ্যাকু দিয়ে মাটি কেটে রাস্তা তৈরি করা হয়েছে? তবে তিনি এই অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন ভ্যাকু দিয়ে কোন মাটি কাটা হয়নি শ্রমিকরাই মাটি কাটছে ।
তার কাছে জানতে চাওয়া হয়,যদি ইজিপিপ’র প্রকল্পে হয় তাহলে কাজ শুরু হওয়ার আগে সাইনবোর্ড টানানো কথা কিন্তু কেন টানানো হয় না? এ বিষয়ে তিনি কোনো জবাব দেয়নি।
এই বিষয়ে ইউনিয়ন চেয়ারম্যান ইউসুফ প্রধানীয়া সুমন’র কাছে জানতে চাওয়া হয় জনমানবহীন বিলে হঠাৎ রাস্তা কেন তৈরি করা হয়েছে? তিনি বলেন , এলাকার বিভিন্ন গণ্যমান্য ব্যক্তিরা আমার কাছে আসছে। এমন মানুষ আসছে। যাদের অনুরোধ ফালাইতে পারি না তাই রাস্তাটি তৈরি করছি।
চেয়ারম্যানের কাছে জানতে চাওয়া হয়, এ রাস্তাটি তৈরি করার জন্য কত টাকা বরাদ্দ ছিল এবং সরকারি কোন প্রকল্পের আওতায় এই রাস্তাটি তৈরি করা হয়েছে ? তিনি বলেন, এ বিষয়ে আমি কোন আপনাকে তথ্য দিতে পারবো না আপনি পিআইও’র সাথে যোগাযোগ করেন। সেখান থেকেই আপনি মূল তথ্য পাবেন।
তার কাছে আরও জানতে চাওয়া হয়, এই রাস্তা তৈরি কাজটি তো ইজিপির’র প্রকল্পের আওতায় ছিল। তাহলে শ্রমিক না দিয়ে ভ্যাকু দিয়ে কেন কাটা হয়েছে? এ বিষয়ে তিনি কোন মন্তব্য জানতে রাজি হননি।
হাজীগঞ্জ উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মোঃ জাকির হোসাইন এর কাছে দুইদিন গিয়েও এই প্রকল্প সম্পর্কে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে তার কাছে এই রাস্তা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি আপনাকে কোন তথ্য দিতে পারবো না। কারন চেয়ারম্যান রাজনীতি করে তাদের অনেক ক্ষমতা। আমি তথ্য দিলে পরে আমাকে নানাভাবে কথা শুনতে হবে। আপনি ইউনিয়ন পরিষদে যান তথ্য পাবেন। আমি এখানে চাকরি করি। কোন ঝামেলায় পড়তে চাই না।
আর কাছে আরো জানতে চাওয়া হয় রাস্তাটি যদি ইজিপিপ’র প্রকল্পের আওতায় তাহলে শ্রমিক দিয়ে মাটি না কেটে ভ্যাকু দিয়ে কিভাবে কাটা হয়েছে? প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা হিসেবে আপনার ভূমিকা কি ছিল ?
এই প্রশ্ন করার সাথে সাথেই তিনি এই প্রতিবেদকে অফিসে রেখে এসি ল্যান্ড কল দিয়েছে বলে অফিস থেকে হয়ে চলে যান।
তবে অভিযোগে আছে, উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা কে খুশি রাখতে পারলেই উপজেলার যে কোন প্রকল্প বাস্তবায়ন করার ক্ষেত্রে চেয়ারম্যান ও মেম্বারদের যেকোনো অনিয়মই নিয়ম হয়ে যায়। আর কোন প্রকল্পের অনিয়ম অসঙ্গতির তুলে ধরতে চাইলেও সাংবাদিকদের কোনো তথ্যই দিবেন না বাস্তবায়ন কর্মকর্তা। এবং ইউনিয়ন পরিষদের থেকেও সাংবাদিকদের কোন তথ্য না দেওয়া অঘোষিত নিদর্শনা রয়েছে।
উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা ও ইউনিয়ন পরিষদ থেকে প্রকল্প বিষয়ক তথ্য সাংবাদিকদের না দেওয়া বিষয়ে হাজীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রাশেদুল ইসলাম বলেন, সাংবাদিকদের তথ্য দেওয়া হয় না। এটা আমি শুনি না। তবে তথ্য লুকানোর বিষয়টা এটা ঠিক না।
জনমানবহীন বিলে এই রকম রাস্তা তৈরি করা কতটুকু যৌক্তিক? প্রশ্ন উঠেছে ভূমি সিন্ডিকেটের সুবিধা দিতে এই রাস্তা তৈরি করা হয়েছে । এই বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আসলে আমাদের যেকোনো প্রকল্প নেওয়া হয় সংশ্লিষ্ট ইউনিয়নের জনপ্রতিনিধি আমাদের কাছে বিভিন্ন প্রকল্পের জন্য চাহিদা দেয়। আমরা সে অনুযায়ী বরাদ্দ দিয়ে থাকি। ইউনিয়ন কমিটি জানে কোন প্রকল্প থেকে কারা সুবিধা পাবে। বিশেষ কোন জনগোষ্ঠী সুবিধা পাবে এটা আসলে তারা জানে।
এছাড়াও জানতে চাওয়া এই প্রকল্প যদি ইজিপিপ’র প্রকল্পের আওতায় পড়ে থাকে ভ্যাকু দিয়ে মাটি কেটে রাস্তা তৈরি করা হয়ে বলে অভিযোগ রয়েছে। এই বিষয়টা ঠিক কি না? এই বিষয়ে তিনি বলেন,’ এই ব্যপারে আপনি চেয়ারম্যানের সাথে কথা বলতে পারেন। তার কাছ থেকে শ্রমিকদের তালিকা চাইতে পারেন। তবে ভ্যাকু দিয়ে মাটি কাটা ঠিক না। কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে ভ্যাকু দিয়ে মাটি কেটে হয়।
উল্লেখ, যে এই অনুসন্ধান চলাকালে রাস্তা কেটে আবার বাড়ানো হচ্ছে।