চাঁদপুরের শাহরাস্তির রাজাপুরা আল আমিন সিনিয়র ফাজিল মাদরাসা পরিচালনা পর্ষদের সাবেক সভাপতি ও অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। এতে শিক্ষার্থীদের শিক্ষা জীবন হুমকির মুখে পড়ার আশংকা করছে স্থানীয় এলাকাবাসী। অনিয়মের বিষয়ে স্থানীয় বাসিন্দা ও মাদরাসার ভূমি দাতা পরিবারের এক সদস্য মোঃ মাহবুব আলম এলাকাবাসীর পক্ষে চাঁদপুরের জেলা প্রশাসক বরাবরে একটি লিখিত অভিযোগ দাখিল করেন।
অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, মাদরাসা পরিচালনা পর্ষদের সাবেক সভাপতি ও বর্তমান এডহক কমিটির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য আলহাজ্ব শাহ মোহাম্মদ নাদিমুর রশিদ একক আধিপত্য বিস্তারের মাধ্যমে কোন নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করেই নিজ খেয়াল খুশি মতো মাদরাসার কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছেন। মাদরাসার অধ্যক্ষ বা অন্যান্য শিক্ষকরা নামমাত্র চাকুরী করেন। মাদরাসাকে কোন ভূমি দান না করেই বিগত ২০১৫ সালে অসদুপায়ে অর্থের বিনিময়ে প্রতিষ্ঠাতা বনে যান নাদিমুর রশিদ। সেই থেকে অদ্যাবধি অর্থের জোরে বিগত সরকারের ক্ষমতার অপব্যবহার করে প্রকৃত ভূমিদাতাদের বাদ দিয়ে নিয়ম বহিঃর্ভূতভাবে মাদরাসা পরিচালনা কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। বিগত সময়ে মাদরাসার অধ্যক্ষদের সাথে যোগসাজসে প্রতিষ্ঠানের আর্থিক অনুদান ও সার্বিক বিষয়গুলো নিজেই কুক্ষিগত করে রেখেছেন বলে জানা যায়। তার একগুয়েমির কারণে মাদরাসার শিক্ষক- অভিভাবকদের মাঝে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। এতে শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার মান সহ স্থানীয় শিক্ষার্থীরা মাদরাসা বিমুখ হতে শুরু করেছে। দিন দিন স্থানীয় শিক্ষার্থী কমে যাওয়ায় মাদরাসাটি অবহেলিত হওয়ার উপক্রম হওয়ায় এবং বিভিন্ন অনিয়মের বিষয়ে ইতোপূর্বেও স্থানীয় বাসিন্দা ও অভিভাবক সদস্যরা অভিযোগ করেও কোন প্রতিকার পাননি।
সম্প্রতি অভিযোগকারী এলাকাবাসীর পক্ষে ভূমি দাতা পরিবারের সদস্য ও স্থানীয় বাসিন্দা মোঃ মাহবুব আলম জানান, আমরা রাজাপুরা মাদরাসাটির ভূমি দাতা। আমার বাবা, দাদা ও স্থানীয় অনেক হিতৈাষী ব্যক্তি মাদরাসা প্রতিষ্ঠাকালীন সময় হতে ভূমি দান করে গেছেন। দীর্ঘ সময় ধরে আমরা দাতা পরিবারের কেউ মাদরাসার উন্নয়ন ও অবকাঠামোগত কোন বিষয়ে জানতে কিংবা কোন বিষয়ে সম্পৃক্ত হতে পারিনি। রাজাপুরা দরবার শরীফের পীর নাদিমুর রশিদ বাবু একক ক্ষমতা বলে বিগত সরকারের আমলে নেতাদের অর্থের বিনিময়ে বার বার নিজেকে প্রতিষ্ঠাতা সদস্য সাজিয়ে সভাপতির দায়িত্ব গ্রহন করছেন। আমরা দাতা সদস্য হয়েও কখনো বলতে পারবো না তিনি কখন, কিভাবে মাদরাসার জন্য কিঞ্চিত পরিমান ভূমি দান করেছেন। নিয়ম বহিঃর্ভূত ভাবে তিনি অর্থের বিনিময়ে সব সময় প্রতিষ্ঠাতা সদস্য দাবী করে সভাপতি হয়েছেন। এমনকি বর্তমান এডহক কমিটিতেও তিনি গোপনে প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হিসেবে অন্তর্ভূক্ত রয়েছেন। আমি এলাকাবাসীর পক্ষে তার বিগত দিনের অনিয়মের ফিরিস্তি উল্লেখ করে এবং মিথ্যা তথ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হওয়ার বিষয়ে চাঁদপুরের জেলা প্রশাসক বরাবর লিখিত অভিযোগ দায়ের করি। অভিযোগে অর্থের বিনিময়ে বিগত ২-৩ জন অধ্যক্ষ নিয়োগ, অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর নিয়োগে অনিয়ম, অধ্যক্ষের যোগসাজসে বিভিন্ন সময়ে মাদরাসার ৩০টির অধিক গাছ কর্তণ করে ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার, মাদরাসার টিনশেড ঘর ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠানে রুপান্তর, মাদরাসার উন্নয়নের কথা বলে বিভিন্ন ব্যক্তি হতে অনুদানের সঠিক হিসেব না দেয়া, ভূমি দান না করেই দীর্ঘ সময় প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হয়ে সভাপতি এবং বর্তমান এডহক কমিটির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য বনে যাওয়া সহ অসংখ্যা অনিয়মের বিষয়ে উল্লেখ করেছি। তাছাড়া বর্তমান অধ্যক্ষ ছায়েদুল ইসলাম গত মার্চ/২০২৪ সালে দাখিল পরীক্ষায় নকল সরবরাহের দায়ে ২ বছর বিনাশ্রম কারাদন্ড ও ১ হাজার টাকা অর্থদন্ডে দন্ডিত হয়েছেন। যে মাদরাসার অধ্যক্ষ শিক্ষার্থীদের নকল সরবরাহ করে, সাধারণ ভাবেই বুঝতে হবে সেখানে লেখাপড়ার গুণগত মান কেমন!! ইতোমধ্যে জেলা প্রশাসক মহোদয় অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (আইসিটি) মহোদয়কে তদন্ত করার নির্দেশ দিয়েছেন। তদন্ত কর্মকর্তা ঘটনাস্থলে এসে তদন্ত করে গিয়েছে। আমরা ব্যক্তিগত আধিপত্য বিস্তারকারী অবৈধ প্রতিষ্ঠাতা সদস্যের হাত থেকে প্রতিষ্ঠানটি রক্ষা ও তার কাছ থেকে বিগত সময়ে প্রতিষ্ঠানের সকল আর্থিক হিসেব এবং দন্ডপ্রাপ্ত এমন অধ্যক্ষকে অপসারণ করতে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের আইনী সহযোগিতা কামনা করি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মাদরাসার এক জেষ্ঠ্য শিক্ষক জানান, মাদরাসাটিতে যেন সকল অনিয়মই নিয়মে পরিণত হয়েছে। কোন শিক্ষকের প্রতিবাদ করার ভাষা নেই। প্রতিবাদ করলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা, হুমকি এমনকি লাঞ্ছিত হতে হয়। ইতোপূর্বে এমন বহুঘটনা প্রত্যক্ষ রয়েছি। প্রতিবাদী শিক্ষক মামলা হামলায় জর্জরিত হয়ে পাগল হওয়ার উপক্রম হয়েছে। এমন নজির রয়েছে বিধায় আমরা কেউ মুখ খুলতে সাহস পাই না। তাই প্রতিবাদ না করে দায়সারা ভাবে চাকুরী করাটা এখন নিত্যনৈমিত্তিক বিষয় হয়ে গেছে।
ইছাপুরা গ্রামের বাসিন্দা মোঃ আরিফুর রহমান ও মোঃ মিলন হোসেন জানান, আমরা ২০১৮ ও ২০২২ সালে অফিস সহকারী হিসেবে আবেদন করি। দুই বার আবেদন করার পরও অদ্যাবধি আমাদের আবেদনগুলোর কোন খোঁজ খবর পাইনি। তারা তাদের মনোভূত লোক অর্থের বিনিময়ে নিয়োগ দিয়েছে। আমাদের আবেদন বাতিল হলে সেটিও আমাদের অবগত করা হয়নি। আমরা ছাড়াও স্থানীয় অনেক আবেদনকারী বলতেও পারবে না কখন নিয়োগ সম্পন্ন হয়েছে। মাদরাসাটি একক ক্ষমতাবলে চলে এখানে কারো কোন বিন্দুমাত্র মূল্যায়ন করা হয় না।
বোস্তা গ্রামের অভিভাবক মোঃ ইউসুফ তালুকদার জানান, এটা শিক্ষা গ্রহনের স্থান বলে মনে হয় না, আমার কাছে মনে হয় ব্যবসায়িক জায়গা। কারণ তারা টাকা ছাড়া কিছুই বুঝে না। আমি আমার মেয়ে ও ছেলের জন্য একাধিক বার মাদরাসায় গিয়েছি। আমার মেয়ের উপবৃত্তি দেয়ার কথা বলে অধ্যক্ষ ও অফিস সহকারী দুই বার টাকা নিয়েছে অথচ উপবৃত্তি পাওয়া সম্ভব হয়নি। তাছাড়া পরীক্ষা ফি ও মাদরাসার বেতন তারা তাদের খেয়াল খুশি মতো আদায় করে। কেউ কিছু করার বা বলার সাহস নেই।
অভিভাবক রুস্তম আলী জানান, আমার একটি মেয়ে ৪ বছর পড়াশোনা করেছে। আরেকটি মেয়ে আজকে ২ বছর পড়ছে এই মাদরাসায়। আমি একজন অসহায় মানুষ, যতোবারই চেষ্টা করেছি উপবৃত্তির জন্য। টাকা চেয়েছে, দেয়ার পরও কোন ব্যবস্থা করেনি। একাধিকবার জিজ্ঞেস করলে শিক্ষকরা খারাপ আচরণ করে। আমি পাশাপাশি গ্রামের বাসিন্দা, অনেক কিছু জানি ও চোখে দেখি। এখানে শিক্ষকদের কথা নয়, উপরের কোন চাপ আছে তাদের উপর। উপর থেকে যা বলে দেয়, সেভাবেই চলে মাদরাসার কার্যক্রম। এখানে আগের চেয়ে বর্তমানে পড়ালেখার মান একেবারেই খারাপ অবস্থা। চাইলেও আমি আমার মেয়েকে এখান থেকে নিয়ে যেতে পারবো না। কারণ তারা কোন ছাত্রছাত্রীকে অন্যত্র যাওয়ার জন্য ছাড়পত্র দেয় না।
মাদরাসার সাবেক অধ্যক্ষ মোঃ আবদুল ওয়াদুদ জানান, আমি ২০১৪ সালে ওই প্রতিষ্ঠান থেকে এসে বর্তমানে মুদাফফরগঞ্জ এ ইউ ফাজিল মাদরাসায় কর্মরত। বর্তমান অধ্যক্ষ ছায়েদুল ইসলাম এই প্রতিষ্ঠান থেকে রাজাপুরা মাদরাসায় যোগদান করেছেন। তবে তিনি আমার প্রতিষ্ঠান থেকে কোন ছাড়পত্র নেননি। তার নিয়োগ প্রক্রিয়ায় কোন সমস্যা না থাকলেও তার বিল উত্তোলনের ক্ষেত্রে ছাড়পত্র বাধ্যতামূলক। সেটি কিভাবে কার্যকর হচ্ছে বা বিল উত্তোলন করছেন তা মাদরাসা কর্তৃপক্ষ ভালো বলতে পারবেন।
মাদরাসার অধ্যক্ষ ছায়েদুল ইসলাম জানান, আমি ২০২৩ সালে যোগদান করেছি। যোগদানের পর থেকেই বিভিন্ন মাধ্যমে জানতে পারি কিছু লোকজন মাদরাসার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছে। আমি জানি না আলহাজ্ব নাদিমুর রশিদ পীর সাহেব কোন ভূমি দান করেছেন কিনা! তবে এটুকু জানি তিনি মাদরাসায় এককালিন অর্থ দিয়ে দাতা সদস্য হয়েছেন। তাছাড়া তিনি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুযায়ী এককালীন অর্থ মাদরাসায় জমা দিয়ে প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হয়ে সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন মর্মে রেজুলেশন রয়েছে। অপর প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, নকল সরবরাহের দায়ে ভ্রাম্যমান আদালত আমাকে সাজা দিয়েছে সেটি সঠিক তবে এটি আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ছিলো। পরবর্তীতে আইনের কাছে আমি সেটি প্রমান করে আদালত থেকে মুক্তি পেয়েছি। এছাড়া অধ্যক্ষকে মাদরাসার প্রয়োজনীয় অনেক বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করলে তিনি সকল কিছুই সাবেক সভাপতি জানেন বলে অবহিত করেন।
মাদরাসা পরিচালনা পর্ষদের সাবেক সভাপতি আলহাজ্ব শাহ মোহাম্মদ নাদিমুর রশিদ অভিযোগের বিষয়ে বলেন আমার বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগগুলো সঠিক নয়। আমার বাবা মৃত্যুর পূর্ব মুহুর্ত পর্যন্ত মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। তার মৃত্যুর পর আমি বিধি অনুযায়ী প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হয়েছি। এছাড়া আরো যে সকল অভিযোগ করা হয়েছে তার সঠিক কোন প্রমানাধি উপস্থাপন করলে আমি স্বেচ্ছায় যে কোন শাস্তি মেনে নিবো। প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হওয়ার পর মাদরাসার উন্নয়নে ব্যক্তিগত উদ্যোগে অসংখ্য কাজ করেছি। তারপরও কিছু অসাধু লোক আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার করছে।
এলাকাবাসীর দাবি, দীর্ঘ বছরের প্রতিষ্ঠিত রাজাপুরা আল আমিন সিনিয়র ফাজিল মাদরাসাটি পরিচালনা কমিটির সাবেক সভাপতি ও অধ্যক্ষের অনিয়মের বলি হতে চলেছে। সাবেক সভাপতি নিজ আধিপত্য বিস্তার করছেন আর একের পর এক যোগদানকৃত অধ্যক্ষ তার ছত্রছায়ায় থেকে সকল অনিয়মের মদদ দিচ্ছেন। একটি দ্বীনি প্রতিষ্ঠান রক্ষার্থে প্রশাসনিক হস্তক্ষেপ ও সংশ্লিষ্ট দপ্তরের আশু সহযোগিতা কামনা করছেন স্থানীয়রা।